নানা রঙের মালায় গাঁথা জন্মদিনের উপহার

15th June 2020 1:51 pm বিনোদন
নানা রঙের মালায় গাঁথা জন্মদিনের উপহার


     নুনম মুখোপাধ্যায় ও ব্রতজিৎ নস্কর 

--------------------------------------

বর্তমান পরিস্থিতি খুবই জটিল আকার নিচ্ছে। অদৃশ্য মারণ ভাইরাস করোনা আমাদেরকে এক প্রকার গৃহবন্দী করেই ফেলেছে। বাঙালি তার সাধের নববর্ষ, রবীন্দ্রজয়ন্তী, জামাইষষ্ঠী সবই এবছরের মত অনলাইনেই সেড়ে ফেলেছে। কিন্তু এরই পাশাপাশি থেমে থাকেনি বেশ কিছু কাজ। আমাদের কাছে এসে উপস্থিত হয়েছে ‘বার্ণিক’এর প্রথম অনলাইন পিডিএফ সংখ্যা। সম্পাদক মহাশয় মধুসূদনবাবুকে এর জন্য অশেষ ধন্যবাদ যে এই রকম বিপদের মধ্যেও তিনি ও তাঁর বার্ণিক পরিবার এই সংখ্যাটিকে খুবই যত্ন নিয়ে উপস্থাপন করেছেন। আর বিশেষ ভাবে ধন্যবাদ জানাবো সৌম্যদাকে এই সংখ্যাটা আমাদের  পড়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। কিন্তু তার পাশাপাশি আরেকটি অসম্ভব কাজ তিনি আমাদের উপরে চাপিয়েই দিলেন। বাংলা পঠন-পাঠনের সূত্রে কম-বেশি লেখালেখির সাথে যুক্ত থাকলেও বুক রিভিউ করার অভিজ্ঞতা আমাদের  একেবারেই নেই। বইটি পাঠ করে যে মনোহর সাহিত্য রস আমাদের  হৃদয়ে উপলব্ধি করেছি তারই খানিকটা এই ‘ফিরে দেখা’র মধ্যে দিয়ে তুলে ধরার চেষ্টা করলাম মাত্র। আপনারা সকলেই সুলেখক। সকলের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা রেখেই আমাদের এই নিবেদন।

রবীন্দ্রনাথ কে? রবীন্দ্রনাথ কি? কেউ বলেছেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রাণের ঠাকুর। আবার কারুর কাছে তিনি ঈশ্বরের সমতুল্য। যার সম্মুখে ধূপ-ধুনো সহযোগে পুজো দেওয়া যায়। করজোড়ে নিবেদন করা যায় -- প্রভু তুমি দেখো, প্রভু তুমি মঙ্গল কোরো। যার জন্য সন্ধ্যেবেলায় শাঁখ বাজে, তুলসীতলায় দেওয়া হয় জল। আবার কারুর চোখে উপনিষদের মর্মগাথার জীবন্ত রূপ রবীন্দ্রনাথ। কথাটা ভুল নয়। রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ব্রাহ্মধর্মের স্তম্ভ স্বরূপ। শিশু রবীন্দ্রনাথ পিতার সাথে চলেছেন হিমালয়। আর পিতা ক্রমাগত মুখস্থ করিয়ে চলেছেন উপনিষদের শ্লোক। শিশুমনে সেই কঠিন কঠোর শব্দগুলো ক্রমশ গেঁথে যাচ্ছে। বিশ্বপ্রকৃতির অপার লীলাখেলার মধ্য দিয়ে তিনি চলেছেন হিমালয় সন্দর্শনে। শিশুকাল আত্মস্থ করার কাল। যে কাল তিনি বেদ উপনিষদ রামায়ণ মহাভারতের বিপুল ঐশ্বর্যের মণিমুক্তা সংগ্রহ করে হয়ে উঠছেন ‘নৈবেদ্য’র রবীন্দ্রনাথ। এই যেন যাত্রার শুরু। রবীন্দ্রনাথ এখানে শুধুই একটা মাটির তাল। যার খুব দূরে আছেন এক রক্তমাংসের মানুষ যার কাছে কবির আকুল নিবেদন -- আমাকে গড়ে তোলো। যেমন করে তুমি চাও ঠিক তেমনি ভাবেই আমাকে গড়ে তোলো। সেই ক্ষুদ্র সংকীর্ণ আমির দেওয়াল ভেঙে কবি যাত্রা করছেন ‘গীতাঞ্জলি’ ‘গীতিমাল্য’ ‘গীতালি’র পথে। ক্রমশ কবি যেন বিশ্ব আমির সাথে একাত্ম হবার পথে উদভ্রান্ত হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছেন। ‘গীতালি’তে গিয়ে কবি খানিকটা শান্ত স্তব্ধ দ্রষ্টা। এই পর্যায়ে এসে কবি যেন অন্তরের সবটুকু নির্যাস দিয়ে অনুভব করছেন
‘দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায় সমানাং বৃক্ষং পরিষস্বজাতে।
তয়োরন্যঃ পিপ্পলং স্বাদ্বত্তি-অনশ্নন্নন্যো অভি চাকশীতি।।’ ঋগবেদ১/১৬৪/২০
যার পূর্ণ প্রকাশ আমরা দেখতে পাচ্ছি কবির শেষ চারটি কাব্যগ্রন্থে। চমৎকার বলেছেন অনিমেষ মণ্ডল। তিনি বলছেন “কোন আদিযুগে নিবিড় আঁধারে উপনিষদের ঋষির ধ্যানে মহান সত্যের যে ধ্রুবতারা জ্বলে উঠেছিল রবীন্দ্রনাথ তাকে অন্তরে লালন করে বিশ্বব্যাপী মানবাত্মার মহামিলনের সাধনা করে গিয়েছেন। সারা বিশ্বময় মানবপ্রীতির এক নিগূঢ় শৃঙ্খল রচনা করতে চেয়েছেন। যে শৃঙ্খলে বাঁধা পড়লে মন আরও উন্মুক্ত হয়, উদার হয়। ঘুচে যায় মানুষের সাথে মানুষের সব বাধা ব্যবধান। যা উপলব্ধি আজকের বিশ্বের অনিবার্য শুশ্রূষা।”

আজকের রবীন্দ্রনাথ আমাদের স্মরণে মননে হতাশার সাধনে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কারুর জীবনে তাঁর নিত্য আসা যাওয়া। কারুর হৃদ মাঝারে তিনি গেয়ে ওঠেন ‘ঘরেতে ভ্রমর এলো গুনগুনিয়ে’। আবার কারুর কাছে দুর্গাপুজো, সরস্বতীপুজোর মতো রবীন্দ্রনাথও একটা পুজোর দিন। ‘তুমি শুধু ২৫শে বৈশাখ’। যেদিন মেয়েদের পরনে থাকবে লাল পাড় সাদা শাড়ি, ফুলের গহনা। ছেলেরা পরবে পাঞ্জাবি। প্রখর গ্রীষ্মের দাবদাহ ফুলের সুবাসে হয়ে উঠবে মাতোয়ারা। সকলে মিলে গেয়ে উঠবে ‘হে নূতন দেখা দিক আরবার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ’। আর অমর সেই শেষ পঙক্তি যেখানে কবি বলে যাচ্ছেন ‘চির নূতনেরে দিল ডাক পঁচিশে বৈশাখ’। সত্যি! একটা জলজ্যান্ত মানুষ তাঁর জীবদ্দশায় লিখে যাচ্ছেন তাঁরই জন্মদিনে গাওয়ার জন্য গান! কার জীবনের জয় ব্যক্ত হচ্ছে? সেই মানুষটির! যিনি তাঁর জীবদ্দশাতেই জানতেন, তিনিই সেই! যার অন্বেষণ প্রতিটি মানুষের অন্তরে। শোকে দুঃখে আনন্দে হতাশায় এসে বসতে হবে এই তাঁরই পদপ্রান্তে। কেন? কারণ তিনিই তো সেই! তিনিই তো সেই অদ্বৈত পুরুষ। যে বেদ উপনিষদের তৃষ্ণায় প্রাণীকুল চাতকের মতো ঘুরে ফিরে মরে আসলে রবীন্দ্রনাথেই তো সেই খোঁজ আছে! জটিল তত্ত্বসমূহের এমন নিটোল সরল নিবেদন আর কেই বা কবে দেখাতে পেরেছিল! সন্দীপকুমার মন্ডল মহাশয় লিখেছেন “রবীন্দ্রনাথ কোনো মানুষ, কোনো কবি, কোনো লেখক, ঔপন্যাসিক বা গীতিকার সুরকার নন। একটা উপলব্ধি, বোধ, চেতনার নাম।”

এই দেখাতে পারার পথ, দ্রষ্টা থেকে স্রষ্টা হওয়ার পথ নিছক সহজ ছিলোনা। বড়োলোক বাড়ির পয়সাওয়ালা ছেলের বিলাস ব্যসনে বখে যাওয়ার সমূহ সুযোগ তাঁর সামনে ছিল! কিন্তু তিনি কি করলেন! তিনি এসে দাঁড়ালেন বীরভূমের সেই রুক্ষ প্রান্তরে, লাল মাটির রাস্তায়। যেখানে তীব্র জলকষ্ট, সাংঘাতিক গরম, ঘরে ঘরে অভাব অনটন যাদের নিত্যসঙ্গী, তাদের মাঝে। এই কষ্টকে যন্ত্রণাকে কবি নিরন্তর উপলব্ধি করেছেন। অসুস্থ রানিকে নিয়ে আলমোড়া থেকে ফিরছেন কবি ট্রেনে। লক্ষনৌ স্টেশনে নেমে দুধ আনতে গিয়ে ফিরে এসে দেখলেন তাঁর টাকা রাখার বটুয়াটা চুরি হয়ে গিয়েছে। উনি হাঁক ডাক করলেন না, চেঁচামেচি করলেন না, রেগে চিৎকার করে ফেটেও পড়লেন না! চন্দ্রিল ভট্টাচার্য খুব সুন্দর ভাবে এই পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথের মনের ভাবটা প্রকাশ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ “নিজেকে জপের মতো বলতে লাগলেন তার চেয়ে মনে করলেই তো পারি টাকাটা যে নিয়েছে সে চুরি করে নেয়নি, আমি নিজে ইচ্ছেপূর্বক তাকে ওটা দান করলুম। হয়তো আমার চেয়েও ওটা তার বেশি প্রয়োজন তাই আমি দানই করেছি।” একদিকে অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে টানাপোড়েন, ইংরেজদের অপমান, নানা রকরের বিরক্তি আর প্রকৃতির অসম্ভব প্রতিকূলতার মধ্যে থেকে একজন রক্ত মাংসের পিতা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন টাকাটা আমি দান করলুম। এই ক্ষমার অনুশীলন কি সত্যিই সহজ? কোনো অভিসম্পাত নয়, কোনো আক্রোশ নয়, ঘৃণায় ফেটে পরা বা তীব্র ধিক্কার নয়। শুধু ক্ষমা। এই ক্ষমা অনুশীলন করতে হয়। নিরন্তর নিজেকে ভেঙেচুরে জাগিয়ে রাখতে হয় একটাই শব্দ, ক্ষমা। ক্ষমা। ক্ষমা। এ যেন সেই সুপ্রাচীন বটগাছ যে যুগ থেকে যুগান্তরে দাঁড়িয়ে আছে স্থির অবিচঞ্চল, এ যেন সেই মহামানব যে বিশ্ব প্রকৃতির ঝড় ঝাপটা নিরন্তর সহ্য করে চলেছে। পাখির ঠোক্কর, কাঠুরের দা এর আঘাতে তীব্র যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে বলে উঠছে, ক্ষমা। ‘আমি যতটুকু দিতে পারি সে তোমারই দান, গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়’।

অনেকের কলমেই বারবার উঠে এসেছে মৃত্যুশোকের কথা। সঞ্চারী ভৌমিকের কলমে অপূর্ব সুন্দর স্পর্শে রবি ঠাকুরই হয়ে উঠেছেন যেন পিতা। পিতৃশোকের অসহনীয় যন্ত্রণা ভুলতে বিশ্বপিতার কাছে তিনি খুঁজে পেয়েছেন আশ্রয়। এই আশ্রয় দেওয়ার কৌশলটিকে আয়ত্ত করাও কি খুব সহজ ছিল! অসংখ্য মৃত্যশোক, কিন্তু বাইরে তিনি স্থির অবিচল পাথরের মূর্তি। কি ছিল মৃত্যু রবীন্দ্রনাথের কাছে? ‘মরণ রে, তুঁহুঁ মম শ্যামসমান’। তিনি মৃত্যুকে দেখলেন ‘অমৃত সমান’ রূপে। দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুকে উপলব্ধি করলেন পরম আত্মীয় রূপে। কবি যেন উপলব্ধির সেই স্তরে গিয়ে উপনীত হয়েছিলেন যেখান থেকে নিশ্চিতভাবে কবি অনুভব করেছিলেন “এই জগৎ সেই মৃত্যুহীন শাশ্বত সত্তার আনন্দ সম্মিলনের মহাপ্রকাশ। বিশ্বসৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ কিংবা প্রত্যক্ষহীন বলে যা কিছু বিরাজিত আছে, তাদের সবই সেই চিরসুন্দর, চিরশুদ্ধ অমরনাথের আনন্দময় অভিব্যক্তি। বিশ্বের সব সৌন্দর্য, পার্থিব জগতের সঞ্চিত সমস্ত সুধা তাঁর থেকে সৃষ্ট বলেই অবিনাশী। অনাদিকাল ধরে নানারূপে বিকশিত। জীবনপ্রবাহ তাই মৃত্যুহীন। হে অমৃতের অমর সন্তান, এই পরম সত্য জ্ঞাত হয়ে অমৃততত্ত্ব লাভ করো।” আর এই দর্শনই যেন রবীন্দ্রনাথের সার্বিক উপলব্ধি। আমরা যাকে মৃত্যু বলে জানি তা তো শুধুই একটা খোলসের বদল। জীবন-সত্যের প্রকাশ মৃত্যুরই মধ্যে দিয়ে। তাই যেন বারবার কবির মনন বলে উঠেছে মৃত্যু বিনাশ নয়, মৃত্যু সমাপ্তি নয়, মৃত্য জীবন থেকে জীবনান্তরে চলাচলের একটা রাস্তা মাত্র। জীবন আসলে মৃত্যুর রঙেই রঙিন। সমস্ত বোধের ঊর্ধ্বে যে বোধ তাতে শোক নেই, দুঃখ নেই, ব্যথা নেই, যন্ত্রণা নেই, উচ্ছ্বাস নেই, উন্মাদনা নেই, আছে শুধু অপার আনন্দ। যেখানে পৌঁছানোর জন্যেও কবির আশ্রয় হয়েছে সেই কবিতা যেখানে কবি লিখছেন ‘নাচে জন্ম, নাচে মৃত্যু, পাছে পাছে’। যেখানে কবি লিখছেন ‘আছে জন্ম আছে মৃত্যু বিরহদহন লাগে। তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে’। কবি আরও লিখছেন,  
“তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যত দূরে আমি ধাই
কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথা বিচ্ছেদ নাই।
মৃত্যু সে ধরে মৃত্যুর রূপ, দুঃখ হয় হে দুঃখের কূপ
তোমা হতে যবে হইয়ে বিমুখ আপনার পানে চাই।
হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে যাহা-কিছু সব আছে, আছে, আছে
নাই নাই ভয়, সে শুধু আমারই, নিশিদিন কাঁদি তাই।
অন্তরগ্লানি, সংসারভার, পলক ফেলিতে কোথা একাকার
জীবনের মাঝে স্বরূপ তোমার রাখিবারে যদি পাই।”

 

সঞ্চারী ভৌমিকের কলমে যিনি চিরসখা চিরবন্ধু, তিনিই সুমনা মজুমদারের বেদনার আকাশে, নারী হয়ে ওঠার নিভৃত জগতের ঠাকুর। আবার তিনিই সম্পৃতা সাহার কলমে ‘রবিঠাকুরের গার্লফ্রেণ্ড’। ভাবনাটি বড়ো সুন্দর। এই কথায় কোনো দোষ দেখিনা। ধৃষ্টতাও দেখিনা। এই পরিসর তো রবিঠাকুরই দিয়েছেন আমাদের। বিশ্বপিতা মেলে দিয়েছেন তাঁর সুবিশাল সাহিত্যের উঠোন। যেখান থেকে তিনি সস্নেহে লক্ষ করছেন তাঁর প্রিয় সন্তানদের দৌরাত্ম্য। তিনি একাধারে পুত্র, পিতা, স্বামী, বন্ধু কিংবা প্রেমিক। তিনি স্নেহকঠোর। তিনিই রঙের কারিগর। তিনিই কিশোরীর প্রথম যৌবনের সমর্পণ। ‘চরণে ধরিয়া তব কহিব প্রকাশি, গোপনে তোমারে সখা কত ভালোবাসি’। আবার তিনিই নারী জাগৃতির প্রথম বোধ, ব্যক্তিত্ব জাগরনের প্রাথমিক সোপান। 
“আমি চিত্রাঙ্গদা, আমি রাজেন্দ্রনন্দিনী।
নহি দেবী, নহি সামান্যা নারী।
পূজা করি মোরে রাখিবে ঊর্ধ্বে
সে নহি নহি,
হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে
সে নহি নহি।
যদি পার্শ্বে রাখ মোরে
সংকটে সম্পদে,
সম্মতি দাও যদি কঠিন ব্রতে
সহায় হতে,
পাবে তবে তুমি চিনিতে মোরে।
আজ শুধু করি নিবেদন–
আমি চিত্রাঙ্গদা রাজেন্দ্রনন্দিনী॥”
সেই যুগে নারীর ললিত আভরণের বিলাস ত্যাগ করে এ কথা আর কেই বা বলতে পেরেছিলেন!


অনবদ্য লাগলো মানস শেঠের গল্পটি। আমরা প্রত্যেকেই রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী। আমরা রবীন্দ্রনাথকে শুনি মায়ের মুখে, রবীন্দ্রনাথকে জানি মায়ের চোখে, যেমন জেনেছিল মানস শেঠের গল্পের নায়িকা। আর ‘রবীন্দ্রনাথকে পছন্দ করিনা’ কথাকটির মধ্যে দিয়ে যেন রবীন্দ্রনাথের তীব্র অনুচ্চারিত শব্দগুলো আর্তনাদের মতো ছড়িয়ে গেছে লেখকের চিন্তা-চেতনার প্রকোষ্ঠে। রবীন্দ্র বিরোধিতা সেই করতে পারে, যে সম্পূর্ণরূপে জানে, কে এই রবীন্দ্রনাথ। অন্যেরা বুলি কপচায় মাত্র। পক্ষান্তরে রবীন্দ্রনাথকে না জেনে তাঁরই ভাবধারা নিজের বলে চালানোর চেষ্টা করে। সে যে মস্ত একটা ফাঁকি সে কথা রবীন্দ্রনাথকে পড়তে গেলেই ধরা পড়ে যায়। এই সূত্রে মনে পড়ে যায় ‘রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক’ প্রবন্ধে বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন আমি একজনকে চিনি যে রাতের পর রাত রবীন্দ্রনাথের পাতা উল্টে চলে, রবীন্দ্রনাথকে আত্মস্থ করে আর দিনের আলোয় সেই রবীন্দ্র বিরোধিতা করে বেড়ায়। বলা বাহুল্য সেই একজন আসলে বুদ্ধদেব বসু নিজেই।


রুমকি রায় দত্ত লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ যেন এক জাদুকর। কখন আসেন কখন চলে যান বোঝা দায়। আর প্রকাশ রায়ের রবীন্দ্রনাথ অনন্ত অসীম। যার কাছে নিঃস্ব হয়ে এসে দুহাত মেলে দাঁড়ানো যায়, যার সামনে বলা যায় ‘আমি বহু বাসনায় প্রাণপনে চাই, বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে’। আর শেষ পর্যন্ত আমরা এসে উপনীত হই আম-বাঙালির রবীন্দ্রনাথে। সৌম্যদা যথার্থই লিখেছেন “তিনি নিজে যা চেয়েছিলেন আর বাঙালি তাঁকে যা বানিয়েছিল দুইয়ের মধ্যে থেকে গেল অনেকটা তফাৎ।” ছোটোখোকার অ আ ক খ র থেকে তিনি ঘুরতে লাগছেন বইয়ের পাতায়। কোথাও তিনি হলেন পুঁজিবাদী ব্যবসার শিকার। কেউ তাঁর ভুল ত্রুটি অনুসন্ধান করে ফেঁদে বসলেন কদর্য উপন্যাসের ব্যাবসা। সস্তার বাজারে সে সব রঙচঙে মশলাদার গল্প দেদার বিকোলো। যেমন স্টেশনে স্টেশনে হকারদের ঝালমুড়ি। তবু রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথই। সৌম্যদার কথায় “তাঁর ব্যক্তিগত জীবন বইপাড়া থেকে স্টুডিওপাড়া সর্বজনীন লোভনীয় বস্তু।” শুভদীপ অধিকারীর কথায় কৃতিদের প্রাইজ দেওয়ার জন্য হট ফেভারিট আইটেম হলো কপিরাইট উঠে যাওয়ার পর সস্তার চকচকে মলাটওয়ালা ‘গীতাঞ্জলি’ কিংবা ‘সঞ্চয়িতা’। আর বেড়াতে গেলে সোনাঝুড়ির হাট। অভাগা বাঙালি বিশ্বভারতী দেখতে দেখতে ক্লান্তি অনুভব করে কিন্তু সোনাঝুড়ির হাটে হার দুল কেনার সময় এনার্জিতে ভরপুর হয়ে ওঠে। সুখেন্দু খাটুয়া রবীন্দ্রনাথের নিম্নবর্গীয় চেতনার অনুসন্ধান করতে গিয়ে বুঝেছেন “রবীন্দ্রনাথ তথাকথিত শুধু প্রকৃতির বা মানবতার পূজারী, প্রেমের কবি, মানুষের মানস জগতের ঔপন্যাসিক শুধু নন, বঞ্চিত, উপেক্ষিত, নির্যাতিত মানুষের প্রতিদিনের দিনলিপির সহমর্মী আলেখ্য রচয়িতাও বটে।” যে আত্মগত উত্তরণের কথা বারবার উঠে এসেছে তৈমুর খানের প্রবন্ধটিতে তিনিই তো প্রতিদিনের রবীন্দ্রনাথ।


গ্রন্থটি রবীন্দ্রনাথের নানামুখী অনুভবে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে সম্পাদকের কৃতিত্ব অনস্বীকার্য। একজন আমায় বলেছিল আমি রবীন্দ্রনাথ পড়িনি কোনোদিন, পড়তেও চাইনা। আমি তাকে বলেছিলাম, তুমি রবীন্দ্রনাথ নাই পড়তে পারো, তাতে কিছুই যাবে আসবে না। কিন্তু জীবনের অসংখ্য অনির্বচনীয় অনুভূতি থেকে তুমি বঞ্চিত থেকে যাবে, এই যা দুঃখের। মানুষকে বলতে শুনি রবীন্দ্রনাথকে পড়া দরকার। পড়লেই জানতে পারবে। আমার ব্যক্তিগত অনুভব থেকে বলি রবীন্দ্রনাথ পড়লে কোনদিনই রবীন্দ্রনাথকে জানা যায়না। রবীন্দ্রনাথকে পাঠ করে তাঁকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হয় নিরন্তর। শয়নে স্বপনে রবীন্দ্রনাথময়তায় ডুবে যেতে যেতেই একদিন রবীন্দ্রনাথের খানিকটা বর্ণচ্ছটা অনুভব করা যায় মাত্র। এতটাই সুবিশাল রবীন্দ্রনাথ। এই রবীন্দ্রনাথ প্রভাতের রঙে রাঙা, দুপুরের ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুর, গোধূলির কনে-দেখা আলো। এই রবি নিত্যই নতুন। মানুষ যাবে আসবে, চিরন্তন রবি সোনাঝরা আকাশে বিরাজ করবেন অনন্ত কাল। সমস্ত ভক্তকে হাসাবেন, কাঁদাবেন, নাচাবেন, পাগল করবেন আবার দেবেন অনন্ত আশ্রয়ও। ইনিই সেই যাঁর সম্পর্কে সমস্ত দ্বিধা দ্বন্দ্বের ঊর্ধ্বে উঠে মুক্ত কণ্ঠে যেন বলা যায়—
‘শৃন্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রা
আ যে ধামানি দিব্যানি তস্থূ’।।
            — শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ, ২/৫
  
‘বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তম্‌
আদিত্যবর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ।
তমেব বিদিত্বাতিমৃত্যুমেতি
নান্যঃ পন্থা বিদ্যতে অয়নায়’।।
            — শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ, ৩/৮





Others News

ফিরে এসো অপু - আকুল প্রার্থনায় আপামর বাঙালী

ফিরে এসো অপু - আকুল প্রার্থনায় আপামর বাঙালী


                    সৌম‍্য ঋষি 

----------------------------------------

আপনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, গভীর রাতে বা ভোরবেলা ফোন বাজলেই চমকে ওঠেন। আবার কারও মৃত্যু সংবাদ এল কি?  এবার কার পালা! 
রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছেন, "আমি পরাণের সাথে খেলিব আজিকে মরণখেলা নিশীথবেলা।" তেমনই আপনার কন্ঠে -" মৃত্যু আয় তিনপাত্তি খেলি"- অমর হয়ে থাকবে। যদিও আপনি লেখেননি, তবু যেন এটা আপনার। আপনার মনের কথাগুলি যেন অনেকদিন বাদে বললেন। আপনার সাদাকালো সিনেমা দেখে যেই প্রজন্ম বড় হয়েছেন তাদের মনে সবসময় আপনাকে আর উত্তম কুমারকে নিয়ে একটা তুলনা চলত। কিন্তু তারাও আপনার অভিনয়ের, কন্ঠের ভক্ত। অথচ বিশ্ববরেণ্য পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের প্রথম পছন্দ ছিলেন আপনি।  আমরা যারা চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের দিকে চলেছি এবং প্রতিনিয়ত আপনার নতুন নতুন কাজ দেখছি, তারা আপনার আকুল ভক্ত। ছোট ছোট বাজেটের ছবি, আর তাতে আপনার উপস্থিতি ছবিটিকে অন্য পর্যায়ে নিয়ে যায়।  আমরা অপুকে চিনি, ফেলুদাকে চিনি, জীবনে কি পাব না গানের সাথে নৃত্যরত সেই অভিনেতাকে যেমন চিনি, তেমন চিনি সেই অগ্রদানী ব্রাহ্মণকে - যার অসহায়তা চোখের জল ধরে রাখতে দেয় না - আবার কুন্তল কেও চিনি, পোস্তর দাদুকে চিনি, বেলাশেষের সেই বৃদ্ধকে চিনি, ধর্ষিতা নাতনির হয়ে বদলা নেওয়া ইঞ্জিনিয়ার  দাদুকে চিনি। পর্দায় আপনার সৌম্যদর্শন চেহারা, বিরামহীন এই কর্মজীবন শুধু আমাদের নয়, আমাদের পরের প্রজন্মকেও আপনার ডাই হার্ট ফ্যান করে তুলেছে। আজ মৃত্যু আপনার কাছে একটি আবশ্যিক ঘটনার মতো। রেখাপাত করার মতো নয়।  কারণ আপনি লিজেন্ড।  আমরা আপনাকে চিনি আপনার কাজ দিয়ে। যা আপনাকে চিরজীবী করবে। ব্যাক্তি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কেমন থাকেন, তাঁর নিজস্ব দুঃখ সুখ,তাঁর জীবনটা কি আমাদের মতোই সাধারণ না রূপকথার মতো - জানি না কিছুই। আপনি এই অসাধ্যসাধনটি করতে পেরেছেন। আমরা ঋদ্ধ হয়েছি আপনার কাজে। প্রণম্য আপনি। সুস্থ হয়ে ফিরে আসুন। না হয় আপাতত কাজ নাই করলেন। তবু জানব আছেন। আর যদি মৃত্যু আপনাকে ডেকে নেয়, তার কারণ অন্য হোক। করোনায় মরণ আপনার জন্য কাম্য না। কক্ষোনো না কক্ষোনো না ----

ছবি : সংগৃহিত